Close

সাংবাদিকের অধিকার রক্ষা : কেউ কথা রাখেনি

রণবীর ভট্টাচার্য

সারা বিশ্ব এখন কোভিডে-১৯ এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কোণঠাসা। টিকা নিয়ে বিভিন্ন দেশ গবেষণা করলেও রাতারাতি ফল পাওয়ার সম্ভাবনা বৈজ্ঞানিক কারণেই সম্ভব নয়। ভারতের মত দেশে যেখানে জনসংখ্যা ও জনঘনত্ত্ব, উভয়েই করোনার অনুকূলে, সেখানে পরিস্থিতি এখনও আশাবাদী হওয়ার মতো নয়। এই অবস্থায় নিরন্তর দেশের মানুষকে সঠিক খবর পৌঁছে যাচ্ছে সাংবাদিকরা। প্রথম সারির হোক কিংবা নতুন, খবরের কাগজ, টিভি বা রেডিও, কিংবা অনলাইন পোর্টাল – সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। আজ ৯ই জুলাই, ‘প্রেস রাইটস ডে’ – ফেসবুকের পাতায় অনেকেই পোস্ট শেয়ার করেছেন। কিন্তু এই কঠিন সময়ে যখন চাকরি চলে যাওয়া ‘স্বাভাবিক’ হয়ে গিয়েছে, সাংবাদিকদের কথা কজন ভেবেছেন?

জয়পুর, আমেদাবাদ, সুরাট, মুম্বই, পুণে – প্রায় তিন মাস সাংবাদিক বরখা দত্ত ট্রাকে করে ঘুরছেন পরিযায়ী শ্রমিকদের সাথে, কখনো বা ট্রেনে। নিজেই জানিয়েছিলেন যে ৮ জেলার ১৪,০০০ কিলোমিটারের বেশি রাস্তা ঘুরেছন পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে খবর করার জন্যে। নিজেই বলেছেন যে টিভি স্টুডিওতে বাস্তব উঠে আসে না। মোজো স্টোরি নাম নিয়ে এই করোনা পর্বে অসামান্য সাংবাদিকতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। কিন্তু তিনি তো বরখা দত্ত, সবাই চেনে। আর বাকিরা?

সবার চাকরি গেলে, সাংবাদিকরা খবর করে। আর যদি সাংবাদিকের চাকরি যায়, তাহলে কে খবর করবে?

এটা কোন নিয়ম নয়, বরং উন্নতিশীল তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর বাস্তব। করোনা পরবর্তী অবস্থা কি দাঁড়াবে সেটা তো করোনা বিদায় নিলে জানা যাবে, কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি সঙ্গীন সাংবাদিকদের। ভারতের মতো দেশে, গনতন্ত্রের অন্যতম একটি স্তম্ভ হল সংবাদপত্র। যখন করোনাভাইরাসের দরুণ লকডাউন শুরু হয়েছিল দেশে, অনেক মানুষ খবরের কাগজ নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন এই ভেবে সংবাদপত্র বাড়িতে করোনা নিয়ে আসবে। কয়েকদিন পর সেই অবিশ্বাসের বাঁধ ভাঙলেও হাল ফিরল না সাংবাদিকদের। অনেকের চাকরি নেই, চাকরি থাকলেও মাইনে নেই। শুধু সংবাদপত্র কেন, টিভি, রেডিও, পোর্টাল – সর্বত্র এক অবস্থা।

কয়েকদিন আগেই জনপ্রিয় ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আমাজন প্রাইমে মুক্তি পেয়েছে ‘পাতাল লোক’ নামে একটি ওয়েব সিরিজ যেখানে নামী টিভি চ্যানেলের সর্বেসর্বা সঞ্জীব মেহরাকে নিয়ে আবর্তিত হয় গল্প। কিন্তু বাস্তবের ভারতে ইংরেজী মাধ্যম ছাড়া স্থানীয় ভাষায় কজন আর রয়েছেন অর্থ, যশ আর প্রতিপত্তি নিয়ে। আজকাল জেলা নিয়ে লেখা বেরোয় কম, কারণ বেশিরভাগ মিডিয়া জেলায় স্থায়ী কর্মী রাখতে পারে না। দরকার পড়লে, যে গ্রামে মোবাইলের টপ আপ ভরে কিংবা সাইকেলের দোকান চালায়, সেই খবর করে দেয়। সাম্প্রতিক অতীতে এবিপি গ্রুপ, টাইমস, আউটলুক… দেশ জুড়ে এরকম কোন মিডিয়া হাউস বোধহয় নেই যেখানে কোন সাংবাদিক চাকরি হারায়নি। ফেসবুকে লেখা হয়েছে, টুইটারে ঝড় উঠেছে, মেলের স্ক্রিনশট দেওয়া হয়েছে – কিন্তু দিনের শেষে বক্তব্য খুবই পরিষ্কার যে সাংবাদিকদের বিকল্প রোজগারের অবস্থা করে নিতে হবে। করোনা না থাকলে অনেকে হয়তো কোন ইভেন্টে গিয়ে দুপুরের খাবার বা রাতের খাবারের বন্দোবস্ত করতে পারতেন। কিন্তু করোনা সেই দিকটিও স্রেফ কেড়ে নিয়েছে।

জনপ্রিয় টিভি সাংবাদিক ফায়ে ডি সুজাকে কে না চেনেন! মিরর নাও ছেড়ে উনি নিজের মত করে ইউটিউবে শুরু করেছেন বাস্তব তুলে ধরা। কি নেই সেই ইউটিউব চ্যানেলে! আগে সব কিছু চাইলেও বলতে পারতেন না, চ্যানেল কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হতো। ওনার অগুনতি ফ্যানরা কিন্তু খুশি যে ফায়ে ডি সুজা নতুন রূপ দিয়েছেন সাংবাদিকতাকে। কিন্তু ভারতে কতজন ফায়ে ডি সুজা হওয়ার সাহস রাখেন? টাইমস অফ ইন্ডিয়ার সাংবাদিক প্রতীক বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলা হয়েছিল সহকর্মীকে বেছে নিতে যাকে কর্তৃপক্ষ চাকরি থেকে বরখাস্ত করবেন। প্রতীক বাবু নিজেই সরে গেছেন। কারোর নাম আলাদা করে সুপারিশ করেননি চাকরি কেড়ে নেওয়ার জন্য।

মন খারাপের ব্যাপার হল, মালিকেরা সাংবাদিকদের লেখার সময় সংবেদনশীল হতে বলেন, কিন্তু তারা যখন চাকরি থেকে ছাঁটাই করেন, তখন কোন দায়-দায়িত্ব থাকে না। মাঝে ভাবা হয়েছিল যে ইন্টারনেট নতুন জায়গা দেবে, কিন্তু এই কঠিন সময় অগুনতি পোর্টাল অস্তিত্বের লড়াইয়ের সম্মুখীন করেছে। এই করোনার সময়ে কিন্তু মানুষ এই উপলব্ধি আরো করতে পারছেন যে ফেসবুক, টুইটারের পাতায় যা দেখছেন সবটাই সত্যি নয়। এখনও ভারতে আমেরিকা, ফ্রান্সের মত মাসিক একটি টাকা দিয়ে খবর পড়ার প্রবনতা হয়নি আর সরকারের বিজ্ঞাপন নিতে গেলে আবার সরকারী লাইনে কথা বলার বাধ্যবাধকতা রয়ে গিয়েছে। সংবাদ মাধ্যমের ব্যবসা আদেও লাভজনক কিনা সেই প্রশ্ন উঠেছে।

মনে পড়ে ভারতের গোবলয়ের কোন এক অখ্যাত মণীশ কুমারের কথা যিনি কয়েকজনের সাথে ভিডিও ভলানটিয়ার নাম নিয়ে একটি ইউটিউব চ্যানেল শুরু করেছিলেন। আজ সেই চ্যানেলের ভিডিও লাখের কাছাকাছি মানুষ নিয়মিত দেখে থাকে। শুধু স্থানীয় খবর নয়, মেয়ে পাচার আটকানোর ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকাও নিয়েছে। সেই হিসেবে অনুদান নেই কিন্তু স্রেফ মনের জোর, আত্মবিশ্বাস আর ইন্টারনেটের বিজ্ঞাপনে ভর করে এগিয়ে চলেছে মণীশ কুমারদের ভিডিও ভলানটিয়ার।

কিন্তু কজন আর বরখা দত্ত, ফায়ে ডি সুজা কিংবা নিদেনপক্ষে মণীশ কুমারের মত সাংবাদিক হতে পারবে? সাংবাদিকতা করে কি আর পেট ভরবে সামনের দিনে? সরকার কি পোর্টালে নিজেদের বিজ্ঞাপন দেওয়ার কথা ভাবতে পারে না বা নিদেনপক্ষে কোন অনুদান?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর বোধহয় সবজান্তা গুগল বা করোনার কাছেও নেই! যতদিন না উত্তর আসবে, ততদিন সাংবাদিকদের অধিকার স্রেফ প্রহসন হয়েই থেকে যাবে।

Leave a Reply

0 Comments
%d bloggers like this:
scroll to top