Close

বিশ্ব দাবা দিবস : দাবা, রাজনীতি আর এক টুকরো ইতিহাস

রণবীর ভট্টাচার্য

গতকাল ছিল বিশ্ব দাবা দিবস। দাবা খেলা নিয়ে সবাই পরিচিত। ভারত থেকে অনেক গ্র্যান্ডমাস্টার বিশ্ব দাবায় যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছেন। আর বিশ্বনাথন আনন্দের দেশ ভারতে কম বেশি সবাই জানেন যে দাবা খেলায় জেতে রাজারা আর বাস্তবের রাজনীতির মতই রাজা প্রায় দরকার না পড়লে নিজের ঘর থেকে বেরোয় না। রাজার সুরক্ষায় সৈন্য সামন্ত তো আছেই, আর আছে হাতি, ঘোড়া, নৌকা আর মন্ত্রী তো আছেই পাশে। তাই আক্ষরিক অর্থই হোক কিম্বা রূপক, দাবা আর রাজনীতি যেন মিলেমিশে গেছে ইতিহাস আর মানুষের জীবনে।

বেশিদিন আগের কথা নয়, কিংবদন্তি স্যার গ্যারি কাসপারভ রাশিয়ায় সর্বেসর্বা পুতিনকে রাজনীতির ময়দানে সোজাসাপ্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন। আরো যদি পিছনে দেখা যায়, দেখা যাবে ববি ফিশারের মত বিতর্কিত চরিত্রকে। সোভিয়েত রাশিয়ার স্প্যাস্কির বিরুদ্ধে ববি ফিশারের জয় ঠান্ডা যুদ্ধের জমানায় এক অন্য আঙ্গিক যোগ করেছিল। তবে একদিকে ববি ফিশার যেমন দাবা খেলার মোজার্ট ছিলেন আবার অন্য দিকে প্রখর সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছেন জীবনে নাৎসিদের উগ্র সমর্থক হওয়ার জন্য। এই চরম বৈপরীত্যের মধ্যেই কিছুটা বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। আর ভারতে দাবার অতীত কিন্তু কম বর্ণময় নয়! পাশা থেকে দাবা, বলতে গেলে মহাভারত তো ঘুরে ফিরে চলেই আসে। যেই দাবা এক সময়ে ‘চতুরঙ্গ’ হিসেবে পরিচিত ছিল, তা পরবর্তীকালে সত্যজিৎ রায়ের ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’তে আমরা দেখি গল্পের পটভূমিকায়। সাম্প্রতিক অতীতে অমিতাভ বচ্চন ও ফারহান আখতার অভিনীত ‘ওয়াজির’ সিনেমায় আমরা আবারও ‘দাবা’কে দেখি স্বমহিমায়।

মজার ব্যাপার হল, দাবা খেলতে স্রেফ বোর্ড ও গুটি চাই, কিন্তু খেলতে গিয়ে রীতিমত বুদ্ধি লাগে। তাই দাবা যুগ যুগ ধরে আলাদা কদর পেয়ে এসেছে সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের কাছে। সারা বিশ্বেই তাই দাবা অনেক পরিবর্তনের মুখোমুখি হয়েছে আর হয়ত সেই জন্যেই ওমর খৈয়াম তার লেখা ‘রুবিয়াত’ কবিতায় বলেছিলেন,’দাবা খেলা তো জীবন মৃত্যুর এক টানাপোড়েন’। বর্তমানের মোবাইলের অ্যাপ নিয়ে তর্ক বিতর্কের মধ্যে ভুলে গেলে চলবেনা যে ভারত থেকে যাওয়া বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের হাত ধরেই কিন্তু দাবা খেলার প্রবর্তন হয়েছিল চীনে। অবাক লাগলেও সত্যি যে ইউরোপিয় রেনেসাঁ অর্থাৎ নবজাগরণের সময়ে কিন্তু আজকের দাবা খেলা তার বর্তমান রূপ পেয়েছিল।

অনেকেরই ধারণা যে দাবা খেলায় হয়তো পুরুষদেরই বেশি প্রাধান্য। এই ধারণা কিন্তু সবৈব ভুল। আজকের ভারতের কোনেরু হাম্পি, দ্রোনাবললি হরিকা, মেরি অ্যান গোমস এর
মতো অনেক বিশ্ববরেণ্য সুপরিচিত খেলোয়াড় রয়েছেন। দাবার জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ হল যে এই খেলার জন্য সেই অর্থে দাবার বোর্ড ও গুটি ছাড়া কিছুর প্রয়োজন নেই। অন্য খেলার অনেক খেলোয়াড় আবার বিশেষ করে দাবা খেলেন মনসংযোগ বাড়ানোর জন্য। এখানেই বোধহয় দাবার সার্থকতা। যুগ যুগ ধরে মানুষ তার নিজের বুদ্ধির তারিফ শুনতে চেয়ে এসেছে। দাবা খেলা কিন্তু এই ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে বুদ্ধির মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে সমাজে অনেক মানুষের কাছে।

আশা কথা, আজকের ভারতে তথা বাংলায় ছোটবেলাতেই অনেক বাবা – মা দাবা খেলার একাডেমীতে ভর্তি করে দেন নিজের ছেলেমেয়েকে। অনেকেই বাড়িতে দাবা খেলে শিখে ফেলেন বাড়ির গুরুজনদের কাছে। কিন্তু প্রতিযোগিতামূলক স্তরে পৌঁছতে গেলে কিন্তু প্রয়োজন বিশেষ দক্ষতার। তাই অনেক বাঙালি কিন্তু আজ টিভির টিআরপির সাথে জেনে গিয়েছে দাবা খেলার এলো রেটিং কি হয়। এখানেই বিশ্বনাথন আনন্দ, সূর্য শেখর গাঙ্গুলি, দিব্যেন্দু বড়ুয়ার মত মহীরুহদের সাফল্য।

Leave a Reply

0 Comments
%d bloggers like this:
scroll to top