আনন্দ সংবাদ লাইভ:বেলঘরিয়া অঞ্চলের কিছু সমমনস্ক মানুষের উদ্যোগে ২০১৮ তে পথচলা শুরু অলাভজনক সমাজকল্যাণমূলক সংস্থা ‘উই কেয়ার ফাউন্ডেশন’ এর। সরকারী নথিভুক্ত এই সংস্থার সদস্যরা যদিও তার আগে থেকেই সারাবছর ধরে নানান কর্মসূচী পালন করেন। সে উৎসবের সময় ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য নতুন জামা কাপড় কিনে দেওয়া হোক অথবা দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনায সাহায্য করাই হোক, মুষ্টিমেয় কয়েকজনের সীমিত ক্ষমতায় চলতে থাকে উই কেয়ার এর কাজ।করোনা অতিমারীর আবহে লকডাউন এর ধাক্কায় যখন গোটা পৃথিবী ধরাশায়ী তখনই রাজ্যের একটা বড় অংশে তান্ডবলীলা চালায় সুপার সাইক্লোন ‘আম্ফান’। এই ঝড়ের দাপটে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দুই চব্বিশ পরগণা জুড়ে থাকা সুন্দরবনের উপকূলবর্তী অঞ্চল গুলি। উই কেয়ার ফাউন্ডেশন এর সদস্যরা সংকল্প নেন অসহায় মানুষের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার। ঐ সব অঞ্চলে ত্রান পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয় । যদিও তাদের কাছে ছিল না তেমন অর্থবল অথবা এমন কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা। আর তখনই তারা সাহয্য নেন সোশ্যাল মিডিয়ার, আজকের যুগে যার ক্ষমতা অপরিসীম। ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপে তাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসেন অনেক চেনা অচেনা সহমর্মী বন্ধু। সেইসব শুভানুধ্যায়ীদের আর্থিক সহায়তা আর শুভেচ্ছাকে সম্বল করে শুরু হয় তোড়জোড়। ত্রাণ সামগ্রী হিসেবে সংগ্রহ করা হয় চাল, ডাল, চিঁড়ে, মুড়ি, ছাতু, সয়াবিন, তেল, নুন, চিনি, কেক, বিস্কুট, সাবান, স্যানিটারি ন্যাপকিনস, ওআরএস, জিওলিন, মোমবাতি, দেশলাই, ব্লিচিং পাউডার, পানীয় জলের জার আর ত্রিপল।এই সমস্ত সামগ্রী নিয়ে উইকেয়ার এর সদস্যরা গত ছয়ই জুন অর্থাৎ শনিবার পৌঁছে যান সুন্দরবনের গোসাবা ব্লকের সাতজেলিয়া গ্রামে। স্থানীয় প্রশাসন এবং স্থানীয় পুলিশের সাহায্যে ত্রাণ সামগ্রী বন্টন করা হয় প্রায় ২০০ পরিবারের মানুষের মধ্যে। দূরদূরান্ত এর গ্রাম থেকে আসা আর্ত অসহায় মানুষ রোদের নিদারুণ তাপ আর ভয়ানক আর্দ্রতাকে উপেক্ষা করেও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে লাইন এ অপেক্ষা করছিলেন। তাদের মুখ ঢাকা ছিল মাস্ক এ অথবা কোন কাপড়ে। সুন্দরবন কোস্টাল থানার ইনচার্জ নিজেও এই ফাউন্ডেশনের সামাজিক কাজের সাথে যুক্ত তাই তার এবং তার টীম অত্যন্ত দক্ষতার সাথে উইকেয়ার এর এই উদ্যোগকে বাস্তবায়িত করার ব্যবস্থা করেন। অশীতিপর বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের দূর থেকে যাতায়াতের জন্য ভ্যান এর ব্যবস্থা করা হয়। অন্তত কিছুদিনের জন্য প্রয়োজনীয় রসদ বিশেষত পানীয় জলের বড়ো জার এবং ত্রিপল পেয়ে মানুষ দুহাত তুলে আশীর্বাদ করেন ফাউন্ডেশন এর সদস্যদের। কচিকাঁচাদের হাতে দেওয়া হয় লজেন্স ও চকলেট যাতে এই দুঃসময় এ তাদেরও মুখেও একটু হাসি ফোটে।সুন্দরবনের এই ত্রানকার্যে গিয়ে উইকেয়ার এর সদস্যরা দেখতে পান নদীর দুধারে জায়গায় জায়গায় কাতারে কাতারে মানুষ ম্যানগ্রোভ অরণ্যের যাবতীয় বিপদকে অগ্রাহ্য করে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার তাগিদে হাত নেড়ে সাহায্য প্রার্থনা করছেন। গ্রামের অসংখ্য মাটির বাড়ি ঝড়ের দাপটে ধুলোয় মিশে গেছে। মানুষ এখনও ফ্লাড শেল্টার বা স্থানীয় স্কুলের পাকা বাড়ির আশ্রয় এ আছেন। দূর্বল মাটির বাঁধ মাইলের পর মাইল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কোথাও কোথাও তার চিহ্নটুকুও নেই। সামুদ্রিক নোনা জল গ্রামের চাষের জমি আর পুকুর খাল বিলে মিশে গিয়ে নষ্ট করে দিয়েছে সব কিছু। তার রঙ হয়েছে লাল, যে রঙ আসলে ওখানকার হতদরিদ্র মানুষের আগামী জীবনে দূর্দশার রঙ। ঐ জমি এবং জলাশয় গুলি দ্রুত নোনাজল মুক্ত করতে না পারলে তা স্হায়ীভাবে ফসল বা মাছচাষের অনুপযুক্ত হয়ে যাবে সেকথা জানালেন স্থানীয় মানুষ তথা পঞ্চায়েত সদস্যরা। তবে তার জন্য প্রয়োজন প্রচুর সাহায্য, সরকারী এবং বিভিন্ন এনজিও র তরফে তার চেষ্টা করা হচ্ছে।এছাড়াও চোখে পড়ে মানুষ এর বসতি গড়ে তোলার খেসারত দিতে অবাধে প্রকৃতির ক্ষতি। নদীর দুপাশে যেখানেই মানুষ এর বাড়ি ঘর সেখানেই ম্যানগ্রোভ অরণ্যের ঘনত্ব অস্বাভাবিক ভাবে কম। সেই মানগ্রোভ অরণ্য যা শুধু বিশ্বের সবচেয়ে বড় বা যা দূর্লভ বন্যপ্রাণীর বিচরণক্ষেত্র তাই নয়, এই অরণ্যই বাকী পশ্চিমবঙ্গকে সারাবছর নানা সামুদ্রিক দূর্যোগের প্রতিঘাত থেকে রক্ষা করে চলেছে আবহমান কাল ধরে। আর তাদের বাঁচিয়ে রাখার কাজ করে চলেছে এখানকার হাজার বছরেরও পুরোনো ভূমিপুত্ররা জলে কুমীর আর ডাঙায় বাঘের সাথে লড়াই করে বা বলা যায় সহাবস্থান করে।উইকেয়ার ফাউন্ডেশন এর সদস্যরা অঙ্গীকারবদ্ধ শুধু এবারেই নয় এর পরেও ঐ প্রান্তিক মানুষদের তথা সুন্দরবনের উন্নতিকল্পে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করার। সাথে সাথে রাজ্যের অন্যত্র প্রতিনিয়ত অসংখ্য অসহায় মানুষের প্রয়োজন এ তাদের পাশে দাঁড়াতে নিজেদের সীমিত সামর্থ্যের শেষটুকু দিয়ে। আর তার জন্য ভবিষ্যতেও তারা পাশে পাবে আরও অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধুকে এই বিশ্বাসটুকুই তাদের কাজের অনুপ্রেরণা ও পথের পাথেয় ।