ফুটবল রাজপুত্রহীন, নিঃসঙ্গ সম্রাট…
✍️সোমনাথ লাহা

পেলে নাকি মারাদোনা? ফুটবল নিয়ে আবেগপ্রবণ বাঙালি তথা তামাম দুনিয়ার ক্রীড়াপ্রেমীদের তর্কর বিচ্যুতি ঘটিয়ে চলে গেলেন দিয়েগো মারাদোনা। অচিরেই রাজপুত্রহীন বিশ্ব ফুটবল। প্রিয় বন্ধুর বিচ্ছেদে নিঃসঙ্গ ফুটবল সম্রাট পেলে তাই আকাশের বুকে কিক অফের বাসনা নিয়ে থাকলেন অপেক্ষায়।
ফুটবল নিয়ে বাঙালির আবেগ চিরন্তন। আর তাইতো ‘সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল’। কিন্তু যখন বিশ্ব ফুটবলের কথা ওঠে.. তখন আলোচোনা থমকে যায় দুটি নামে। পেলে এবং মারাদোনা। ছোটবেলায় যখন থেকে ফুটবল দেখছি তখন ঠাকুমার মুখে এই দুই ফুটবলারের নাম শুনেছিলাম। একজন ফুটবলের সম্রাট তো অন্যজন ফুটবলের রাজপুত্র। আর শুনেছি দুটি দেশের নাম, একটি ব্রাজিল এবং অপরটি আর্জেন্টিনা। লাতিন আমেরিকার দুই দেশের দুজন কিংবদন্তি ফুটবল খেলোয়াড়। আরও পরে জেনেছিলাম রীতিমতো খেটে খাওয়া, সংগ্রাম করে উঠে আসা এই দুই দেশ( ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা) শুধু একটি ভালোবাসাকে নিয়েই বাঁচে, তার হলো ফুটবল। আর শহর তিলোত্তমা তাই মোহনবাগান-ইষ্টবেঙ্গলের মতো বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় দুভাগে বিভক্ত .. ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। কিন্তু গতকাল রাতে এমন এক ইন্দ্রপতন ঘটল.. যে বাঙালির বিশ্ব ফুটবলের আলোচোনায় ছন্দপতন হয়ে গেল। চলে গেলেন বিশ্ব ফুটবলের রাজপুত্র দিয়েগো মারাদোনা। মাত্র ৬০বছর বয়সে রাজার মতোই চলে গেলেন তিনি। নীল-সাদা দশ নম্বর জার্সিতে নিজের ড্রিবলিং- পাসিং, আগ্রাসী মেজাজে ময়দানের সবুজ গালিচায় ঈশ্বর প্রদত্ত বাঁ পায়ের স্কিলে ক্রীড়াপ্রেমীদের হৃদয়ে ঝড় তোলা রাজপুত্র চলে গেলেন তাঁর রাজমুকুটটিকে নিয়ে। আর একইসঙ্গে বাঙালির বিশ্ব ফুটবল নিয়ে তর্কে পড়ে গেল ভাঁটা। অনেকটা নুন বিহীন রান্নার মতো। পেলে নাকি মারাদোনা? শ্রেষ্ঠ কে.. আসলে এই দুই কিংবদন্তি হলেন বিশ্ব ফুটবলের সূর্য ও চন্দ্র। এঁরা দুজনেই পথিকৃৎ। বিশ্ব ফুটবলের প্রতি বাঙালি তথা তামাম বিশ্বের ক্রীড়াপ্রেমীদের আকর্ষণ করার সেই চুম্বকীয় স্তম্ভ। আর তাইতো বিশ্ব ফুটবলের আঙিনায় এর পরেও বহু ফুটবল খেলোয়াড় এসেছেন, ভবিষ্যতেও আসবেন। কিন্তু অক্ষয় অমর হিসাবে ফুটবলের স্বর্ণাক্ষরে লেখা পেলে ও মারাদোনার অভ্যন্তরেই বিলীন হয়ে যাবেন তারা। কারণ ফুটবলের আকাশে নক্ষত্র অনেক। কিন্তু সূর্য ও চন্দ্র র মতো একজন একচ্ছত্র সম্রাট এবং একজনই রাজপুত্র। আমি কট্টর ব্রাজিল সমর্থক। কিন্তু মারাদোনা ও তার বাঁ পা কে কুর্ণিশ জানাতে আমার মনে কোনো দ্বিধা নেই। ফুটবল সম্রাট পেলের খেলা আমি লাইভ দেখিনি। কিন্তু মারাদোনার খেলা দেখেছি। এখনো মনে আছে ৯০এর বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির কাছে হেরে মারাদোনার কান্না। আসলে মারাদোনা মানেই আবেগ, হৃদয়ের গাঁথা মালা। পেলে ফুটবল খেলতেন মস্তিষ্ক দিয়ে আর মারাদোনা খেলতেন আবেগ দিয়ে। মনে আছে দূরদর্শনের ন্যাশনাল চ্যানেলে সুপার সকার দেখতাম রবিবার দুপুরে। শুধুমাত্র পেলে ও মারাদোনাকে আরও একটু ভালো করে জানার জন্য। ১৯৯০এর বিশ্বকাপ ফুটবল দেখার জন্য রাতে ঠাকুমার ডেকে দেওয়া এখনও মনে আছে। মারাদোনার পাস থেকে ক্যানিজিয়ার গোল। সবটাই ছবির মতো আঁকা যেন। আর তাই আজও বিশ্ব ফুটবলে যত দেশই অংশগ্রহণ করুক না কেন ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার খবর থাকলেই দেখি। কলকাতা বড় ভাগ্যবান। আর একইসঙ্গে ভাগ্য আমাদেরও। বিশ্ব ফুটবলের এই দুই কিংবদন্তি তথা মহীরুহ পেলে ও মারাদোনার পা পড়েছে এই শহরে। পেলে তো কসমস ক্লাবের হয়ে খেলেও গিয়েছেন এই শহরে। আর মারাদোনা খেলেননি ঠিকই, কিন্তু ১৯৮৬তে নিজের আগ্রাসী, দাপুটে স্কিলের জোরে আর্জেন্টিনাকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন করার পাশাপাশি কলকাতার তৎকালীন ব্রাজিল বূহকে ভেঙে ফুটবল আবেগে এক হাড্ডাহাড্ডি বিষয়কে নিয়ে আসেন। ভাগ হয় শহর তিলোত্তমার বিশ্ব ফুটবলের মানচিত্র। একদিকে ব্রাজিল এবং অন্যদিকে আর্জেন্টিনা। আর তাইতো মারাদোনার প্রয়াণে একা হয়ে যাওয়া ফুটবল সম্রাট পেলের স্বীকারোক্তি “একদিন আকাশে একটা বলে আমরা একসঙ্গে কিক করব”। একসঙ্গে কোনো দিন যাঁরা ইহজগতে সবুজ গালিচায় ফুটবল নিয়ে মুখোমুখি সন্মুখ সমরে দাঁড়াননি তাদের মুখোমুখি হওয়ার জায়গা বোধহয় ব্রক্ষ্মান্ড। তবে রূপকথা সাঙ্গ করে চলে যাওয়া ফুটবলের রাজপুত্রর জীবন একদম ফুলে বিছানো নয়। বরং কাঁটাও রয়েছে তাতে। বিতর্ক, মাদকাসক্তি, অসংযমী জীবনযাপন। তাইতো মারাদোনা তাঁর ষাটতম জন্মদিনের শেষ সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন…”ফুটবল আমাকে সবকিছু দিয়েছে। আমি যতটা ভাবতে পারতাম তার থেকেও বেশি। আমি যদি নেশার কবলে না পড়তাম, তাহলে আরও বেশি দিন খেলতে পারতাম। মাঝে মাঝে ভাবি মানুষ কি আমাকে আগের মতো আর ভালোবাসবে…” আসলে এই মাদকাসক্ত, অসংযমী জীবনযাপনের আবর্তে মাত্র ষাট বছরেই এই পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে হারিয়ে গেলেন ফুটবলের রাজপুত্র। প্রশ্ন একটাই এত ফ্যান, ক্রীড়াপ্রেমী মানুষের ভালোবাসার কথা ভেবে নিজের জীবন নিয়ে কি আরেকটু সংযমী হতে পারতেন না মারাদোনা? কিন্তু আবেগী মন বোধহয় এমনই হয়। ফুটবল যতদিন রয়েছে পেলে-মারাদোনারা থাকবেন। সম্রাট থাকলেন, রাজপুত্র চলে গেলেন… ভবিষ্যতে ব্যাটন হয়তো আবারও কোনো তারকার অপেক্ষায় থাকবে। কারণ মেসি-নেইমার সেই পথ অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে পারেন ঠিকই কিন্তু তাঁদের পক্ষে পথিকৃৎ বা মহীরুহ কোনোটাই হয়ে ওঠা সম্ভবপর নয়। সেগুলো এক-আধজনই হয়ে থাকেন। তাই তাঁরা কিংবদন্তি, লেজেন্ড। আর কিংবদন্তি যে অমর। তাই তো তাঁরা হারিয়ে গিয়েও রয়ে যান আজীবন।