ছবির নাম : ঝরা পালক
পরিচালনা: সায়ন্তন মুখোপাধ্যায়
অভিনয়ে : ব্রাত্য বসু, জয়া আহসান, রাহুল ব্যানার্জি
রেটিং : ৩.৫/৫
✍🏻প্রিয়রঞ্জন কাঁড়ার
চিত্রকল্পের অলীক সাম্রাজ্যে বিভোর এক কবির মানস-দিগন্ত জুড়ে শুধুই বহুমাত্রিক নারীসত্তার উপাসনা। সময়ের থেকে বহু যোজন এগিয়ে থাকা সেই পুরুষ স্রষ্টার স্বপ্নের নারী ভীষণভাবেই যৌনতার মেটাফোর। যে নারীর স্তনবৃন্ত থেকে যোনিদেশের অতলস্পর্শী গভীরতায় অবগাহন করে একই সাথে বিশ্বদর্শন ও জীবন দর্শন সেরে ফেলেন কবি। আরূঢ় ভণিতায় কর্দমাক্ত ও চোখে অক্ষম পিঁচুটির কাজল পরা সমকালীন ছায়াপিণ্ডদের বিষাক্ত সমালোচনাকে কোনও রকম পাত্তা না দিয়েই। এমন এক ব্যতিক্রমী, প্রতিস্পর্ধী কবির বায়োপিক বানাতে গেলে পরিচালককেও সমপরিমাণ সৃষ্টিশীল, নিঃশঙ্কচিত্ত ও আত্মপ্রত্যয়ী হতে হয়। সৌভাগ্যক্রমে সায়ন্তন মুখোপাধ্যায় সেটা অবলীলায় হতে পেরেছেন। আর বাণিজ্যলক্ষ্মীকে বাজার-চলতি নৈবেদ্য দিয়ে তোষামোদ না করার এই একগুঁয়ে যজ্ঞের নির্মাতা হিসেবে ততোধিক সাধুবাদ প্রাপ্য প্রযোজক পবন কানোড়িয়ার।
মধ্যরাতে কবরের মাটি খুঁড়ে নিষ্প্রাণ নারীদেহ নিয়ে ঐহিকদর্শিতার পরিচয় দেয় যে পাগল, তার জীবন-অনুসন্ধিৎসাও জীবনানন্দ দাশের কবিসত্তার সঙ্গে কোনও এক দুর্বোধ্য বিন্দুতে সমাপতিত। লাল ফুলের পাপড়িতে ঢাকা শ্বেতশুভ্র চাদরের ওপর শায়িত রামধনুর মতো বর্ণময় নারী-শরীরকে পরিক্রমা করে যে কৌতূহলী ইঁদুর, সেও কবিসত্তার এক মহার্ঘ্য নৈঋত কোণ। নিজের জ্বলন্ত চিতার সামনে শূন্যতাময় অথচ কৌতূহলে ভরপুর দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কবি-অবয়বের অসহায়তা তীব্রভাবে বাঙ্ময়। তখনই দর্শক-মনে একটি বিশেষ ভাবের উদ্রেক হয়, ট্রামের আঘাতে কবি-মৃত্যু আসলে কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আজীবন বাস্তবকে অস্বীকার করে আসা এক বোহেমিয়ান স্রষ্টার জীবন যেন সুনির্দিষ্ট ও নিরবচ্ছিন্ন কার্য-কারণ সম্পর্কের অলঙ্ঘ্য নির্দেশেই জাগতিক যান্ত্রিক আঘাতে ভূপতিত হয়েছে।
এই ছবি আসলে কবিরই নানা চিত্রকল্পকে ব্যবহার করে কবির চেতনাকে এবং সেই চেতনার অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণকে ধরার একটা অনবদ্য প্রয়াস। বায়োপিকের স্বাভাবিক ক্রনোলজি মেনে চলার কোনও চেষ্টা সেখানে ছিল না। জীবনানন্দের স্বপ্নদর্শী অপরিণত তারুণ্যের আবেগ ও বিহ্বলতাকে চমৎকার এঁকেছেন রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায়। পরিণত জীবনানন্দের ভগ্নহৃদয় জীবনযোদ্ধার রূপটিকে বিশ্বাসযোগ্যতা দান করেছেন ব্রাত্য বসু। কবিজায়া লাবণ্যপ্রভার চরিত্রের বহুস্তরীয় বিন্যাসটিকে সঠিকভাবে অনুসরণ করেছেন জয়া আহসান। কখনও স্বামীর প্রতিভায় মুগ্ধ গর্বোচ্ছ্বাস, আবার কখনও সাংসারিক দায়িত্ব থেকে এসকেপিস্ট স্বামীর প্রতি বিরক্তি ও অভিমান। প্রতিটি অভিব্যক্তিতেই চরম পেশাদারিত্ব দেখিয়েছেন জয়া। কবির আত্মজা মঞ্জুর ভূমিকায় নবাগতা অন্তরজিতা পালের সাবলীল অভিনয় প্রত্যাশা জাগায়।
সমগ্র ছবি জুড়ে জীবনানন্দের কবিতার নেপথ্য ফিসফিসানি সুপ্রযুক্ত। দৃশ্যকল্পগুলির সার্থক নির্মাণে অভিজিৎ নন্দীর সিনেমাটোগ্রাফি ও প্রদীপ্ত ভট্টাচার্যের সম্পাদনার যুগলবন্দি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।